করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে সাধারণ ছুটি ও বিধিনিষেধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ক্ষতি অন্যদের চেয়ে আরও বেশি। এমন তথ্যই উঠে এসেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৬৪ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে দেওয়া অর্থ থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এ সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এই সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পরে সুপারিশটি বাস্তবায়নের জন্য গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আরেকটি চিঠি দেশের সব জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) জি এস এম জাফরউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফাইলপত্র না দেখে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।’করোনাকালে শ্রমিকরা আয়-ব্যয়ের তারতম্যে অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তবে নাম প্রকাশ না করে একজন কর্মকর্তা জানান, কঠোর লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকায় বিরূপ প্রভাব নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে শ্রমজীবী বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের করুণ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে। একটি সুপারিশে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি রয়েছে। গত ১৬ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল উপ-সচিব (ইউপি-১) মো. আবু জাফর রিপনের স্বাক্ষরে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকদের কাছে আমরা সুপারিশ পাঠিয়েছি। এখন তারাই এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’
প্রতিবেদনে যা আছে
‘কঠোর লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকায় বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদনে’ বলা হয়েছে, দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের কারণে সরকার গত ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ, সাধারণ ছুটি, লকডাউন ঘোষণা করে সংক্রমণ রোধের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে ছয় কোটিরও বেশি শ্রমজীবী নিয়োজিত রয়েছে, যার ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। লকডাউনের কারণে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ বিশেষ করে গণপরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেলওয়ে কুলি, দিনমজুর, ঘাট শ্রমিক, নরসুন্দর, রিকশা-ভ্যানচালক, শপিংমল-দোকানপাটে নিয়োজিত শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির দিনমজুরদের অনেকেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে হতাশায় ভুগছেন।
করোনা মহামারির কারণে গত দেড় বছরে কর্ম হারিয়েছে বহু মানুষ
সরকার এরই মধ্যে এসব বেকার শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা সমাধানে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় ও স্থায়ী কোনো সমাধান না হওয়ায় দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমতাবস্থায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি বিশেষ পরিকল্পনা না নিলে সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ এসময় কর্ম হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন। দেশের জিডিপির সেবা (৫৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ), শিল্প (৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশ) ও কৃষি (১৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ)—এই তিনটি প্রধান খাতের মধ্যে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবাখাত।
প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৬-২০১৭ (সর্বশেষ জরিপ) অনুসারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী সক্রিয় শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি ৩৫ লাখ; এর মধ্যে বেকার জনবল ২৭ লাখ। খাতওয়ারি তিনটি বড় পেশা হলো—সেবা, শিল্প ও কৃষি। এর মধ্যে লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবাখাত। বর্তমানে এ খাতে নিয়োজিত রয়েছে এক কোটি ২৩ হাজারের বেশি শ্রমজীবী মানুষ।
লকডাউনে সংকটে পড়েছেন নির্মাণশ্রমিকরাও
‘প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব শ্রমজীবী মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা হারে রোজগার করলে বছরে প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা আয় হয়। এ খরচের পুরো টাকাই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় মেটানোর জন্য খরচ করে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল সংযোজন। কিন্তু মহামারি করোনা ও চলমান লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষ।’
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, হতদরিদ্রের হার ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (বিবিএস)। সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশ হলেও বেসরকারি জরিপ সংস্থা সিপিডির মতে ৩৫ শতাংশ এবং পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) ও বিআইজিডির (ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) মতে, দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। করোনা সংক্রমণ ফের বাড়লে এ হার আরও দ্রুত বাড়তে পারে বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, চলমান মহামারির মধ্যে সরকার এক লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশের বেশি। কিন্তু এসব প্যাকেজের বেশিরভাগই প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বণ্টন করা হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে এরূপ কোনো সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। কারণ এসব শ্রমিকের কোনো সংগঠন নেই। সরকারি প্রণোদনা পাওয়ার বিষয়ে এসব শ্রমিকের দাবি তোলার সামাজিক সক্ষমতা তৈরি হয়নি। তৈরি পোশাক ও পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন এবং নেতৃত্ব থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের দাবি নিয়ে কথা বলার মতো কোনো নেতৃত্ব নেই।
শ্রম অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের জন্য করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে শ্রম পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে নারী শ্রমিকদের আয়েও
এতে বলা হয়, বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ—যেমন নির্মাণশ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেলওয়ে কুলি, ঘাট শ্রমিক, দিনমজুর, ভাসমান মানুষ, রিকশা-ভ্যানচালক, নিম্নবিত্ত মানবিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য পরিবারসহ এমন ৫০ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা করা হয়। স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের জন্য প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এ সহায়তা পাচ্ছে না বিধায় এ উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দুর্দশা লাঘব করতে পারছে না বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সুপারিশ
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সব ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের পরিচয়পত্র ও পেশা অনুসারে নিবন্ধনের আওতায় আনা যেতে পারে। যেন যে কোনো সংকটকালে তাদের চিহ্নিত করে সহযোগিতা, রেশনিং ও পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়।
ই-সার্ভিস ও ই-কমার্স খাতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা নেওয়ার মাধ্যমে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিক্রয়কর্মীদের বিকল্প পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য ‘সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০২০’ দ্রুত বাস্তবায়ন করা ও সব শিল্পখাতের মধ্যে এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা নিশ্চিত করতে নিজ নিজ কারখানায় তাদের ডাটাবেজ তৈরিতে কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের মাঝে প্রচারণা চালানো এবং উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
ভিজিডি, ভিজিএফ ও রেশন কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা), গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি ও অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামে ফিরে আসা কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শিল্পখাতের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মহীন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৬৪ জেলার (সব ইউনিয়নসহ) জেলা প্রশাসকের কাছে প্রদেয় অর্থ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করে মোবাইল ব্যাংকিংসেবার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
পরিবহন শ্রমিকসহ অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন, সুলভ মূল্যে বাসস্থানসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও সঞ্চয় প্রবণতা সৃষ্টির জন্য সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।